কোভিড-১৯ বিষয়ক ডেটা নিয়ে এক দেশের সঙ্গে আরো এক বা একাধিক দেশের ডেটা তুলনা করা কি ঠিক? এ বিষয়ে সংবাদকর্মীদের ভাবা প্রয়োজন। মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে তাদের মূল্যবান ভূমিকার কারণেই এই ডেটা তুলনা বিষয়ে তাদের ভাবা প্রয়োজন। অনেক সংবাদমাধ্যমেই বাংলাদেশের কোভিড-১৯ পজিটিভ ও মৃতের সংখ্যাকে অন্য দেশের সঙ্গে তুলনা করতে দেখা যায়। এ ধরনের তুলনা মানুষকে সচেতন করে না, বরং তাকে আতঙ্কিত করে তোলে। তার মানসিক চাপ বাড়ায়।
কেন কোভিড-১৯ ডেটার দেশভিত্তিক তুলনা ঠিক নয়? এর উত্তর এক কথায় সম্ভব নয়। সংক্রমণ হার বা মৃত্যু হার কোনোটিই তুলনীয় নয়। মৃত্যুহারের তুলনা কেন ঠিক নয় তা অন্য আলোচনার জন্য তোলা থাকল। এ লেখায় শুধু সংক্রমণ ডেটার তুলনা বিষয়ে কথা বলা যাক।
ধরা যাক আজ আমরা আশপাশের কয়েকটি দেশের কোভিড-১৯ পরীক্ষা ও শনাক্তের হার তুলনা করছি। দেশগুলো হলো ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশ। ইন্দোনেশিয়ায় একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পরীক্ষাকৃতদের প্রায় ২৩ শতাংশ কোভিড-১৯ পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন। পাকিস্তানে পজিটিভ হয়েছেন পরীক্ষাকৃতদের ১২ শতাংশ।ধরা যাক নিচের চিত্রটি (ক) এই চার দেশের আজকের কোভিড-১৯ ডেটার তুলনামূলক চিত্র।
(ক) ৩১ মার্চ পর্যন্ত পজিটিভ শনাক্তের হার
দেশ |
শতাংশ |
বাংলাদেশ |
৩.১৮ |
ভারত |
৩.৩১ |
ইন্দোনেশিয়া |
২২.৯৩ |
পাকিস্তান |
১২.১৪ |
এই চিত্র দেখে বা এই তুলনা জেনে আজ থেকে ১৫ দিন পর কোন্ দেশের কী অবস্থা হবে সেই ভাবনা আমাদের মাথায় আসবে নিশ্চয়ই। একবার ভাবুন তো ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানে নিকট ভবিষ্যতে তাহলে কত মানুষ কোভিড-১৯ পজিটিভ হতে যাচ্ছে? অন্যদিকে ভারত ও বাংলাদেশে কোভিড-১৯ পজিটিভ হচ্ছেন পরীক্ষাকৃতদের ৩ শতাংশ। এই দুই দেশ নিশ্চয়ই বাকি দুটি দেশের তুলনায় ভাল অবস্থায় থাকবে নিকট ভবিষ্যতে?
এবার ওই চার দেশেরই আরেক গুচ্ছ ডেটা দেখা যাক। ধরা যাক ডেটাগুলি আগামী ১৫ দিন পরের ডেটা। এই ডেটাও পরীক্ষাকৃতদের মধ্যে কোভিড-১৯ পজিটিভের সংখ্যা বা শতাংশ নিয়ে। দেখুন নিচের চিত্রটি (খ) :
(খ) এপ্রিল ১৬ পর্যন্ত পজিটিভ শনাক্তের হার
দেশ |
শতাংশ |
বাংলাদেশ |
৯.৩১ |
ভারত |
৪.৬৮ |
ইন্দোনেশিয়া |
১৫.৭৭ |
পাকিস্তান |
৮.০৮ |
ই্ন্দোনেশিয়ায় পজিটিভ হচ্ছেন প্রায় ১৬ শতাংশ, পাকিস্তানে ৮ শতাংশ, ভারতে প্রায় ৫ শতাংশ এবং বাংলাদেশে ৯ শতাংশ। এবার কি ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানের সাথে সাথে বাংলাদেশকে নিয়েও দুশ্চিন্তা হচ্ছে না? ‘ক’ চিত্রটির ডেটা তুলনা করে বাংলাদেশকে নিরাপদ ভাবা সম্ভব। আবার ‘খ’ চিত্রটির তুলনা করে বাংলাদেশকে বিপদগ্রস্ত ভাবা সম্ভব।
কিন্তু এই তুলনা কি আমরা করব? করা উচিত হবে কি এই তুলনা? ‘ক’ চিত্রের ৩ শতাংশ কোভিড-১৯ পজিটিভের যে-ভারত সেই ভারতে প্রথম পজিটিভ শনাক্ত হন ৩০ জানুয়ারি। তারপর দেশটি পরীক্ষা শুরু করে। আর বাংলাদেশে প্রথম পজিটিভ শনাক্ত হন ভারতের সোয়া এক মাস পর (৮ মার্চ)। ৩১ মার্চ পর্যন্ত প্রায় ২৭ হাজার পরীক্ষা করে ফেলা ভারতের সাথে একই সময়ে দেড় হাজার পরীক্ষা করা বাংলাদেশের তুলনা করা ঠিক নয়।
(গ) ৩১ মার্চ পর্যন্ত মোট পরীক্ষা
দেশ |
মোট পরীক্ষা |
বাংলাদেশ |
১,৬০২ |
ভারত |
২৬,৭৯৮ |
কেন ঠিক নয়? সময়ের ব্যাপ্তির পার্থক্যের কারণে এই দুই দেশের তুলনা ঠিক নয়। কিন্তু ইন্দোনেশিয়া বা পাকিস্তান? তাদের সাথে তুলনা করতে পারি তো? কারণ ইন্দোনেশিয়ায় প্রথম পজিটিভ শনাক্ত হন ২ মার্চ, পাকিস্তানে ১ মার্চ। তাদের সাথে আমাদের পজিটিভ শনাক্তের সময়ের ব্যবধান তো মাত্র ৬/৭ দিন? দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই তুলনায়ও আমরা যেতে পারি না। পারি না পরীক্ষার সংখ্যার ব্যবধানের কারণে। একই কারণে বাংলাদেশে প্রায় ১৭ হাজার পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পরও ওই দেশগুলির সাথে আমাদের তুলনা করা যায় না।
(ঙ) ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত মোট পরীক্ষা
দেশ |
মোট পরীক্ষা |
বাংলাদেশ |
১৬,৮৮৭ |
ইন্দোনেশিয়া |
৩৪,৯৭৫ |
পাকিস্তান |
৭৮,৯৭৯ |
বস্তুত সংক্রামক রোগের বিস্তারে আর্থ-সামাজিক অবস্থা, ব্যক্তিগত জীবনযাপন পদ্ধতি, পারপার্শ্বিক পরিবেশ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা সবকিছুরই একটি নেপথ্য ভূমিকা থাকে। এসব মাপকাঠির কারণেই বিশ্বের প্রতিটি দেশ আরেকটি দেশ থেকে ভিন্ন, এমনকি ভৌগলিকভাবে পাশাপাশি বা কাছাকাছি হলেও। সংক্রমণের সময় ও পরীক্ষার সংখ্যা ব্যবধান ছাড়াও এই মাপকাঠিগত ভিন্নতার বিষয়টি আমরা মনে রাখতে পারলে ভাল। তাহলে সংক্রামক রোগের ডেটার দেশভিত্তিক তুলনা করার আগে আমরা দু’বার ভাবব। আর এসব ‘ভাবনা’ পর্যায়ের কথা অসমীচীন মনে হলে নিচের চিত্রটি অন্তত দেখে নেব দেশভিত্তিক ডেটা তুলনার আগে।
(ঘ) দুই সময়ে মোট শনাক্তের সংখ্যা
দেশ |
৩১ মার্চ পর্যন্ত |
১৬ এপ্রিল পর্যন্ত |
বাংলাদেশ |
৫১ |
১৫৭২ |
ভারত |
৮৮৭ |
১৩,৪৩০ |
ইন্দোনেশিয়া |
১,৫২৮ |
৫,৫১৬ |
পাকিস্তান |
১,৯৩৮ |
৬,৩৮৩ |
দেখা যায় প্রায় ২৩ শতাংশ পজিটিভ হারের দেশ ইন্দোনেশিয়ায় ১৫ দিনের (৩১ মার্চ-১৬ এপ্রিলে) ব্যবধানে পজিটিভ ব্যক্তির সংখ্যা ৩,৯৮৮ জন। আর ৩.৩১ শতাংশ পজিটিভ হারের দেশ ভারতে পজিটিভ ব্যক্তির সংখ্যা বেড়েছে ১২,৫৪৩ জন। কী এক আশ্চর্য! ১৫ দিনে কী এমন বদলে গেল এই দুই দেশে! কিছু না আসলে। শুধু পরীক্ষার সংখ্যা বদলেছে!
(ঙ) ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত মোট পরীক্ষা
দেশ |
মোট পরীক্ষা |
ভারত |
২,৮৬,৭১৪ |
ইন্দোনেশিয়া |
৩৪,৯৭৫ |
এই যে পজিটিভ শনাক্ত ও পরীক্ষার সংখ্যাজনিত পরিবর্তন, এও কিন্তু তুলনীয় নয়!
ডেটা সূত্র :
১. https://www.tableau.com/covid-19-coronavirus-data-resources
২. https://data.humdata.org/dataset/total-covid-19-tests-performed-by-country
[লেখাটি ১৯ এপ্রিল bdnews24.com-এ প্রকাশিত]